বঙ্কিমচন্দ্র | অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত
ত্রয়োদশ পর্ব
ছবি : হোসেন জার
আমার গলাধঃকরণের পর সেই সমস্ত উপাদান আমায় বয়ে নিয়ে গেছে, যা আমি একটু আগে গিলেছি
—‘ডানা ফেলে গেছে যারা’, সোফিয়া পান্ডিয়া
টপ্পা
যদি
কোনওদিন অন্ধও হয়ে যাই, বধির যেন না হই কখনও। শব্দ। শব্দ। মাঝরাতে হিম পড়ার শব্দ থেকে ব্লেড দিয়ে কড়াইয়ের কালি চাঁছার শব্দ, বেড়ালের
গোঙানি, বঁটিতে আলুর খোসা কাটার শব্দ, দেশলাই জ্বালাবার ফস্ থেকে প্রতিমা বড়ুয়ার
গানের ঢোলক, দোতারা। নিধুবাবুর গলা। পৃথিবীর সব শব্দ যদি শুনে যেতে পারি, পৃথিবীর সব দৃশ্য সব
রঙ কল্পনা করা যেতে পারে।
….
বাগবাজারের রসিকচাঁদ গোস্বামীর বাড়িতে মাঝরাতে গানের আসর। পাশাপাশি
বসে রামনিধি গুপ্ত, বাংলার নিধুবাবু। আর দেবব্রত
বিশ্বাস। নিধুবাবুর টপ্পা আর দেবব্রতর গলায় রবিবাবুর গান।দেবব্রত একটু আগে
গাইছিলেন, তোমার কাছে এ বর মাগি, মরণ হতে
যেন জাগি। এত আড়ম্বরহীন,
আয়োজনহীন ভাবে গেয়ে গেলেন, যেন স্বগতোক্তি। নিজের মনে গাওয়া।
কাউকে শোনাবার জন্য কোনও আনুষ্ঠানিকতাই নেই। এত কম শ্বাসবায়ু ছাড়ছিলেন, মনে হচ্ছিল
নিজের কাছে এ বর মাগি গাইছেন।
শেষ করে ভোররাতে বেরিয়ে আসছেন রামনিধি গুপ্ত। রাতের
এই গানের আসর আগে নিধুবাবু বসাতেন শোভাবাজারে। এখন রসিকচাঁদের বাড়িতেই গান করেন। আসর
শেষে দলবেঁধে বেরিয়ে আসছেন শ্রোতারাও। নিধুবাবুর বাঁ দিকে পাথুরিয়াঘাটার শ্রীদাম
দাস আর ডান দিকে তাঁর প্রধান শিষ্য মোহনচাঁদ বসু। আজকের শ্রোতাদের মধ্যে
বঙ্কিমচন্দ্রও ছিলেন। তিনিও বেরিয়ে এসেছেন। দানাদার তানকারির ঘোর এখনও তাঁর
কাটেনি। মনের মধ্যে সুরগুলো ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। ধোঁয়ার মতো সেগুলো কুণ্ডলী করে
জড়িয়ে জড়িয়ে ওপরে উঠছে। মিলিয়ে যাচ্ছে। আবার ধরে নিচ্ছে সুর। গত কয়েকদিন অস্থির
হয়ে আছেন খুব। কিছুতেই আর শান্ত হচ্ছে না মন। ছাদে একা বসে থাকেন। নিরুপায় ও বন্দী
থাবা দিয়ে শূন্যে আঁচড়ান। হাওয়ায় দাগ থেকে যায় নখের আঁচড়ের। মানুষ তা টের পায় না। ভূতেরা
হয়ত পায়। কোথায় গেলে যে মন শান্ত হবে বুঝতে পারছেন না।
টাঙানো মশারির পাশাপাশি দুটো দড়ি খুলে নিলে যা হয়—দুপাশে তুলে ধরা বিস্তৃত
দুই হাত—ঘাড় ও মাথা ঝুলে পড়েছে—আত্মসমর্পণরত এক মানুষ।
একবার দেখা করলেন মাইকেলের সাথে। তাঁরও একই অবস্থা।
কিছু একটা এক্ষুনি করা দরকার। কাউকে একটা জবাব দেওয়া দরকার। অথচ উপন্যাস লেখা ছাড়া
আর কীইবা তাঁর
হাতে আছে। অরুণেশকে এখন এখানে পেলে বড় ভালো হত। লোকটার একটা লাথি মারার শক্তি আছে ভেতরে।
সেটা ওঁর কথায় বোঝা যায়। কিন্তু আবক্ষ মূর্তি হয়ে সব কিছু অবিচল দেখে যাওয়া ছাড়া
আর কোনও ক্ষমতা তাঁরও নেই। এই অস্থির,
স্থূল মুখোশের আড়ালে ক্ষমতা ও দখলদারি নিয়ে বাঁজা
সময়টার মাথায় হাতুড়ি তাহলে কে মারতে পারে। মাঝে মাঝে মনে হয় মাইকেলই ঠিক করেছিল
বিদেশে চলে গিয়ে। কেন যে মরতে আবার ফিরে এল। ওঁর দাঁড়াও পথিকবর দাঁড়িয়ে শোনার ও
রক্তস্রোত দিয়ে তা অনুভব করার ধৈর্য,
প্রয়োজন,
প্রজ্ঞা আর কারোরই নেই। সবাইকে পচিয়ে গলিয়ে নষ্ট করে
দিয়েছে সময়টা। পরীক্ষাহীন নিরীক্ষাশক্তিশূন্য তর্জা ও খেউড় লেখকরাই মন্ত্রীর হেগো
পাছা মুছে করে কম্মে খাচ্ছে। মানুষ মরে গেলেও যেভাবে, সিলিং ফ্যান ঘুরতেই থাকে, হাওয়া
দেয়, টিভি চলতেই থাকে, মৃতদেহকে এন্টারটেইন করে যায়। বঙ্কিমচন্দ্র কি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন? নিজেকে প্রশ্ন
করেন। মাথার ভেতরটা কুয়াশা ঢাকা। মাইকেলের কাছে গেলে, সে বলে, মদ্যপান
করুন বঙ্কিমচন্দ্র, মদ্যপান করুন আরও বেশি করে। দেখবেন আপনি নর্মাল হয়ে
উঠছেন। বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ অনেকদিন আগেই গজিয়েছে। এখনও তা সইতে শিখলেন না।
নর্মাল হন বঙ্কিম। আরও
নর্মাল হন।
বিছানার ওপর পাশাপাশি দুটো দড়ি খুলে রাখা টাঙানো-মশারির দু পাশে তুলে ধরা
বিস্তৃত দুই হাত দেখে সে ভাবে, সে, নিজেই, টাঙানো রয়েছে, এভাবে, আসলে। অ্যান
এগজ্যাক্ট অ্যান্ড ডুপ্লিকেট কপি অফ হিমসেল্ফ, অর্থাৎ রেপ্লিকা, সে রেখে গেছে এ
ঘরে। দু পাশে তুলে ধরা বিস্তৃত দুই হাত—ঘাড় ও মাথা ঝুলে পড়েছে বুকের দিকে—আত্মসমর্পণরত
এক মানুষ, পাশাপাশি দুটো দড়ি খুলে নেওয়ার পর টাঙানো মশারির দুপাশে তুলে
ধরা বিস্তৃত দুই হাত।
একমাত্র নিধুবাবুর গান শুনলে বঙ্কিমের মন শান্ত হয়
কিছুটা। সঙ্গমের পর যে তৃপ্তি ও ক্লান্তি জড়িয়ে ধরে মানুষকে, সেরকম
মনে হয়।
একটা ট্যাক্সি ধরে তার পেছনের সিটে বসেন নিধুবাবু ও দেবব্রত। শ্রীদাম আর মোহনচাঁদ চলে গেছেন ততক্ষণে।
বঙ্কিমচন্দ্রও নিধুবাবুদের সঙ্গ নেন। যদি আরও কিছুক্ষণ তানকারির
রেশ জড়িয়ে থাকা যায়। সামনে, ড্রাইভারের
পাশের সিটে গিয়ে বসেন বঙ্কিম। নিধুবাবু ড্রাইভারকে বলেন, ‘একটা
ভালো মিষ্টির দোকান দেখলে গাড়িটা একটু থামিও তো ছোকরা। অনেকদিন ভালো কালাকাঁদ খাই
না। জমিয়ে কালাকাঁদ খেতে মন চাইছে। অবশ্য এত ভোরে কোন দোকানই বা খোলা পাবে।’ একটু পরে, বঙ্কিমের
উদ্দেশে বলেন, ‘এই বাগবাজারে এলেই আমার ভোলা ময়রার কথা বড় মনে পড়ে... ভারি
দরাজ গলা ছিল। মাথাটা
একটু মোটা ছিল, এই যা। বুদ্ধি ছাড়া কি শিল্প হয়—।’
—‘এখন
যাঁরা সঙ্গীত নিয়ে কাজ করছেন তাঁদের মধ্যে কার কার মগজে বুদ্ধি আছে বলে আপনার মনে
হয়?’
নদী
থেকে একবাটি জল তুলে ল্যাবরেটরিতে এনে তার জীবাণু পরীক্ষা করা যেতেই পারে। সে
পরীক্ষায় কোনও ভুল নেই। কিন্তু সেটা ওটুকুই, তার বেশি নয়। ওই জলের স্যাম্প্লের
রিপোর্ট দেখে নদীকে বুঝতে যাওয়াটা, অন্ধের হাতি দেখা। কেননা, নদীর পার্বত্যগতি থেকে নিম্নগতি,
বিভিন্ন পর্যায়ে তার প্রবাহের চরিত্র, এবং উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত পার্শ্বভূমিতে
তার বিস্তার, নিজের পেটের ভেতরে নিয়ে চলা বিবিধ প্রাণি, জীবজগৎ, ভেসে আসা মড়া, জড়
ও পলি, তার জলে দিনের কিংবা রাতের আলোর এবং অন্ধকারের রকমারি খেলা, ছোট-বড়ো বিবিধ
নৌকার চলাফেরি ও নৌকার মাঝিদের গান ও হাঁকাহাঁকি ইত্যাদি ওই একবাটি জলের স্যাম্প্লে
থাকে না। নদীকে নিয়ে কথা বলতে হলে, গোটা নদীটাকে নিয়েই বলতে হয়, একবাটি জলের নমুনায়
ল্যাবরেটরির কাজ মেটে, শিল্প-সাহিত্যের কিছু হয় না।
—‘একালে বুদ্ধি কি কারও মগজে আছে নাকি? সে তো
এখন চোয়ালে। মনোজ মিত্তিরের চোখে আঙ্গুল দাদা পড়া নেই?’
পাঞ্জাবির পকেট থেকে কাগজে মোড়া পান বের করতে করতে দেবব্রত বলেন, ‘দ্যাহেন
বঙ্কিমচন্দ্র, কানে কানে ভেদাভেদ থাকবেই। সব কান তো একরকম হয় না। আমায় বরং ভাবায়
রবীন্দ্রনাথ। নিজের পূর্ণশক্তি পাবার জন্য বৈষম্যের আঘাতের অপেক্ষা আপনারে করতেই
হইব। কোনও
সভ্যতাই একা আপনাকে আপনি সৃষ্টি করে নাই। সঙ্গীত
তো একটা সভ্যতা, নাকি? রবীন্দ্রনাথ এই কথাটা বুঝতে পারছিলেন খুউব
ভালো কইরা।’
এবং, এখানেই সে লক্ষ করে, কী সেই অপূর্বভাবিত দৃশ্য, যেখানে মাঝরাতে, যীশু
স্বয়ং হয়ে যাচ্ছেন ক্রুশ। আর ক্রুশটি এইমাত্র হস্তান্তরিত হওয়া যীশুর প্রাণ নিয়ে,
সামনে, স্পষ্ট উঠে আসছেন। ওই তো! ঠিক যেভাবে, মশারির পেছনটায় সে গিয়ে দাঁড়ালে,
তাকে মনে হবে ক্রুশ। স্থবির, কিন্তু মৃত্যুচিহ্নবৎ। দু পাশে বিস্তৃত মশারির দুই দড়ি
বরাবর নিজের দু হাত ছড়িয়ে দিলে যা আরও বিশ্বাসযোগ্য ক্রুশের এক চরিত্র হবে।
‘তিলককামোদ একটা রাগ,’ নিধুবাবু বলেন, ‘আজকের এই আমোদগেঁড়ে
বাঙালি আমোদটুকুই খালি নিয়েছে। মাথায় রাজার মতো তিলক নিতে পারল না। যাই হোক, এই রাগটা
খম্বাজ ঠাট থেকে তৈরি হয়েছে। আমাদের টপ্পার অনেক গানই এই খম্বাজের ওপরে। কোনও কোনও
অংশে এই রাগকে সোরঠ কিংবা দেস রাগের মতো লাগে। সমগ্র উত্তর ভারতে এই রাগে কোমল
নিষাদ একেবারে বর্জিত। কোমল নিষাদ যোগ করলে এটা বিহারী রাগ হয়ে যায়। মল্লিকার্জুন
মনসুরের গলায় কখনও শুনবেন এই বিহারী। মনে হবে বাউলাঙ্গ রাগসঙ্গীত শুনছেন। অসাধারণ।
তো, যা বলছিলুম, অথচ মহারাষ্ট্রে এই রাগে শুদ্ধ কোমল দুরকম নিষাদই
প্রয়োগ করা হয়। পনী সরী গসৌ রিশ্চ পমৌ গসৌ রিগৌ সনী — এই হল এর
পকড়্। কিংবা
ধরুন ভৈরবীর কোমল গান্ধার আর দরবারীর কোমল গান্ধার যে আলাদা, এইসব তো
এক একটা টেকনোলজি। একধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং। কজন এসব বুঝে উঁকি দেয় বলুন? এপৃথিবীতে
খুব বেশি সংখ্যক কান কি আছে এসব বোঝার?
না, নেই। যাদের সে কান নেই, নেই বলে
তারা কিঞ্চিন্মাত্রও লজ্জিত নয়। এক একটা গান তো এক একটা গ্রহ। এক একটা আলাদা
বিশ্ব। সেই গ্রহে অবতরণের উপায় সে-ই খুঁজবে যে সেখানে নাবতে চাইবে। তুমি নীল
আর্মস্ট্রং না হলে চাঁদ কি সেধে তোমার পায়ের নীচে আসবে বাবা?’
একটু থেমে বলেন, ‘এই যে
আপনার মনে এত কষ্ট হয়, সে কি আমি আর বুঝি নে!’
বঙ্কিম চমকে তাকান নিধুবাবুর দিকে। থট রিডিং জানেন নাকি
ভদ্রলোক। মিটিমিটি হাসতে হাসতে নিধুবাবু বলেন, ‘বুঝি
বুঝি, সবই তো বুঝি। গানটা তো আমিও বানাই নাকি? আপনার কি
মনে হয় না বন্দেমাতরমটা কী কুক্ষণে লিখতে গেলেন। মনে হয়
না ফিরিয়ে নিই লেখাটা? সবাইকে পারলে বলে দিই ওটা আমার লেখা নয়। আমি চাই না
ওর নীচে আমার নাম আর লেখা
থাক। কোনও
ভারতমাতাকে নিয়ে আমি ও স্তোত্র লিখিনি। সপ্ত কোটি কন্ঠ বাংলার কন্ঠ। দ্বিসপ্ত কোটি
হাত বাংলার মানুষের হাত। এই একটা লেখার জন্য আপনার কি আফশোস হয় না বঙ্কিম? এই একটা
গান আজ গোটা দেশের দিকে চেয়ে কী ব্যঙ্গের হাসি হাসছে হ্যা হ্যা করে।’
এবং, মশারিটি তখন ক্রুশের আনুভূমিক দুই প্রান্তে গেঁথে রেখেছে নিজের
করকুর্চাস্থি। যাকে আমরা পেরেকে বাঁধা মশারির দড়ির গিঁট ভাবছি। এবং এমত ভেবে ভুল
করছি। মশারিটি তৎক্ষণাৎ সে, অথবা যীশু। আর সে, অবধারিত ক্রুশ। যাকে পিঠে নিয়ে আছে
মশারি অথবা সে অথবা যীশু।
একদিন
হয়ত আমি আমার থেকেও বেরিয়ে আসব, ফেটে যাওয়া পাকা ফলের বিচির মতো। আমিই পড়ে থাকব
আমার পাশে। এই শহরের সাথে যা আমি করেছি। করছি। এই
শহরও কি পারে না আমার প্রতি ঠিক একইরকম প্রতিশোধ নিতে? ইন্এক্সপ্লিসিট এক
ঘাতকের মতো সে শুধু আমার পেছন পেছন এসে দাঁড়াবে, ‘ঝোপের আড়াল থেকে হেঁটে এসে একা’। তার
মারণাস্ত্র চিরকাল হয়ে থাকবে অনাবিষ্কার্য। মৃত্যুটা, স্বপ্নে না জেগে থাকার
ভেতর, জানতেই পারব না। ফল থেকে বেরিয়ে আসা বিচির মতো দেখব। নিজেকে।
চোখ
ফ্যাটফ্যাট করে।
বুকের ভেতর থেকে লাভাস্রোতের মতো কান্না উঠে আসে
বঙ্কিমের। কাঁদতে পারেন না। মাঝরাতে ফাঁকা রাস্তায় শাঁ শাঁ ক’রে ছুটছে
ট্যাক্সি। বঙ্কিমচন্দ্র জানলার কাচ নামিয়ে মাথা এলিয়ে দেন হাওয়ায়। ঠাণ্ডা হাওয়া
এসে লাগে চোখে নাকে মুখে।
কিন্তু, সে রাতের হাওয়ায় কিছু ছিল। যা গায়ে লেগে চলে যায় না। বেদানার দানার মতো ঠেসে বসে
থাকে মাথায়। মাথায় ছড়াতে থাকে প্রশ্নবংশ। যদি এই ঠাসা বেদানার খুলি নিয়ে চলতে হয়
তাহলে নিজেকেই নির্মাণ করতে হবে উত্তরবংশ। একের পর এক প্রশ্নের ঢেউ আছাড় খায়
গুরুমস্তিষ্কে।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment