ধর্ষণ নিয়ে
অজস্র প্রতিবাদী কবিতা লেখা হয়ে চলেছে, কিন্তু, এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে, বিশেষ করে
পশ্চিমবঙ্গে, অন্যতম প্রাণঘাতী যে সমস্যা, সেই বায়ুদূষণ নিয়ে কোনো কবিতা আমি আজও
দেখতে পাইনি। কিন্তু কেন? কবিরা কি পরিবেশের বাইরে? কেন বধূহত্যা নিয়ে কবিতা লেখা
হয়, কিন্তু বেআইনি হাতি বা বাঘ শিকার নিয়ে লেখা হয় না? প্রেম নিয়ে যত কবিতা লেখা
হয়, বিবাহ নিয়ে হয় না কেন? বেকারত্ব নিয়ে কবিতা লেখা হয়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে কেন
নয়? চাঁদ নিয়ে লেখা হয়, কিন্তু ওজন স্তরের ক্ষয় নিয়ে নয় কেন? এগুলোর উত্তর খোঁজা
যাক। উত্তরটা আমি সংস্কৃত সাহিত্যের রস বিভাজনে খুঁজতে চাই না। কারণ, এটা
কালিদাসের কাল নয়। এবং, উপরের ছবিটা মাইকেলেঞ্জেলোর।
কেউ
আপনাকে নিরপরাধ ও বিনা প্ররোচনায় একটা ঘুষি মারলে আপনি কী করবেন? কেঁদে ফেলবেন।
তেড়ে যাবেন পাল্টা। অজ্ঞান হয়ে যাবেন। এগুলো জৈবিক ক্রিয়া অথবা, প্রতিক্রিয়া। একটি
পশুও এক্ষেত্রে একইরকম প্রদর্শন করবে। বাঘকে ঘুষি মেরে দেখুন, অথবা আপনার পাড়ার
ভুলো কুকুরকে। দাঁত কাকে বলে নখ কাকে বলে জানতে
পারবেন। আপনাকে ঘুষি মারা হল, আপনি যদি সেই ঘুষির ব্যাপারে থানায় যান, যদি কোর্টে
কেস করেন, আপনি সামাজিক আচরণ করবেন। কিন্তু সমাজ কি জৈবিক নয়? থানা কি পাশবিকতার
কোনোরকম বাহক নয়? আইন?
যেহেতু
মানুষ এক সামাজিক পশু, ঘুষি খেয়ে পালিয়ে যাওয়ার বদলে থানা বা কোর্টে যাওয়াটাও আদতে
তার জৈবিক ক্রিয়া, অথবা প্রতিক্রিয়া। ঘুষিটা খাওয়ার পরে আপনি উকিলের কাছে গেলেন,
নিজেই কিল মারলেন, নাকি কোনো সুপারি কিলারকে ভাড়া করলেন, ব্যাপারটা একইরকম পাশবিক,
কারণ আপনি নিজেরই আঘাতের প্রতিশোধ ও প্রতিকার চাইছেন, নিঃস্বার্থ নন আপনি, এ কোনো
আপন হতে বাহির হওয়া ঘটনা নয়, বিড়ালের
ইঁদুর শিকার অথবা ইঁদুরের বিড়াল স্বীকারের মতোই কিছু।
ক্ষমাও মানুষের সিদ্ধান্ত থেকে আসা উচিত, তার স্বভাব থেকে নয়। বিনা বিবেচনায় ক্ষমা
করা যার স্বভাব, সে দেবতা নয়, সে তৃণভোজী পশুই।
প্রত্যেক
প্রাণীর মতো মানুষেরও সিরকাডিয়ান সিস্টেমের মধ্যে মিশে রয়েছে এক অটোমেটিক
পেসমেকার। মানুষও চলে এক বায়োলজিকাল ঘড়ি অনুসারে। মধুকর যেমন প্রত্যুষে মধু
সংগ্রহে বেরোয়, এবং ভীমরুলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, মানুষও সকালে বাজারে পটি করে
বাজারে যায়, সেই ঘড়ি অনুসারে, এবং রাত্তির এগারোটায় জীবনসঙ্গীর পাশে বা উপরে বা
পিছনে শুয়ে-বসে-দাঁড়িয়ে প্রেম করতে চায়, অথবা ভাবে তার বিজনেস রাইভ্যালকে কী ভাবে
নিকেশ করা যায়। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে। স্বভাব অনুসারে যদি ভাবা হয়, তাহলে ভাবনাও
একটা জৈবিক ক্রিয়া, পশু-প্রবৃত্তি, তাকে চিন্তা বলা যায় না।
তাই, যদি আপনি চাঁদের থাপ্পড় খান?
দুর্দান্ত চাঁদের আলোয় চাঁদই আপনাকে থাপ্পড় মারল, আপনি ফ্ল্যাট হয়ে গেলেন। ওই ঘড়িই
ঠিক করে দেবে আপনি কতক্ষণ মূর্ছিত থাকবেন। বিশ্বচরাচর
জোছনায় ভেসে যেতে যেতে আপনাকে ঘা মারলে আপনি কোর্টে গিয়ে কেস করেন না, আপনি সুপারি
কিলার বা উকিলের কাছে যান না। আখতারি বাঈ-এর গজল চালিয়ে দেন। কবিতা লিখতে বসেন।
বলুন তো? এটাও কি জৈবিক ক্রিয়া নয়? চন্দ্রাহত মানুষকে যে বিশ্বাস করা যায় না, সে
বাড়ির বাইরে গেলে উদ্বেগ হয় আদৌ ফিরবে কিনা, তার হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ছাড়া যায়
না, কেন? কারণ সে তখন তার দেবত্ব ছেড়ে পশুত্বের দিকে রওনা দিয়েছে। সে সামাজিক নয়,
সত্যিই, কিন্তু ততটাই কি সত্যি যে সে পশুও নয়?
মানুষ পারে নেড়ি কুকুরকে বিস্কুট দেখিয়ে ডেকে তার মুখে জ্বলন্ত চকলেট বম্
গুঁজে দিয়ে আনন্দ করতে, মানুষ পারে তিনমাসের শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করতে, এবং উল্লাস
করতে, মানুষের আনন্দকে তারপর আর কতটা শ্রদ্ধা করা যায়? মানুষ পারে নিজের গর্ভজাত
সন্তানকে ডাস্টবিনে ফেলে রেখে চোখ মুছতে মুছতে দুঃখিত মনে চলে যেতে, তারপর আপনি
মানুষের দুঃখকে কতটা বিশ্বাস করবেন? মানুষ এসব পারে, কোনো চতুষ্পদ পশু পারে না।
মনুষ্যত্ব জিনিসটা এক তাজ্জব পশুত্ব, অনেক সময়ই, সেটা গ্র্যান্ড পিয়ানোর পাশে হোক,
বা খালপাড়ের বস্তিতে।
নারীর
স্তন দেখে যাকে কবিতা লিখতে হয়, মানুষের কান্না দেখে যাকে কবিতা লিখতে হয়, সে
ব্যাখ্যাতা নয়, সে দিশারীও নয়, সে নিতান্তই সেই লোকটা যে থাপ্পড় খেয়ে হরমোনকে
আত্মনিবেদন করে, স্নায়ুতন্ত্রে আত্মসমর্পন করে। উত্তরপ্রদেশে
সন্তানের গলায় ছুরি ঠেকিয়ে মা-কে ধর্ষণ করা হয়েছে, এটা খবরের কাগজে পড়েই আপনি
কবিতা লিখতে বসে গেলেন, ফেসবুকে পোস্ট করে দিলেন। এটাও কাজ নয়। এটা স্বনির্বাচিত
সাড়া দেওয়াও নয়। কারণ, আপনার ওই ক্রিয়া যারা পড়বে, প্রতিক্রিয়া দেবে, তারা কেউই
ধর্ষন করার লোক নয়, সেটা তাদের স্বভাবে নেই, স্বভাবে থাকলেও তারা দমন করতে শিখেছে। যারা
ধর্ষণ করে, তারা আপনার হরমোন আর স্নায়ুতন্ত্র পড়ে না।
পরের
দিন কাগজে আবার একটা অনুরূপ খবর আপনি ঠিকই দেখতে পাবেন। যে লোক খুব সহজে ধর্ষণ
নিয়ে কবিতা লিখতে পারে, সে নিজে সুবিধেমতো জায়গায় পেলে একটা অসহায় মেয়েকে বা
দুর্বল পুরুষকে না চুদে ছেড়ে দেবে, এটা বিশ্বাস করি না। বাঁড়া যদি খাড়া হয়, মানুষ
নিজেকেই অবাক করে দিতে পারে নিজের আচরণে। ঠিক সেই অবাকই তাকে করে দিতে পারে নিজের
বা অন্যের লেখা কবিতাও। আমাদের ভাবা উচিত, কেন বৈষ্ণব পদাবলী জনপ্রিয় হল শাক্ত
পদাবলীর চেয়ে, কারণ, বৈষ্ণব পদাবলী আমাদের হরমোন সিস্টেমের উপরে সরাসরি ক্রিয়া
করে। কেন ভূতের গল্প জনপ্রিয় হয়? কারণ ভূতের গল্প সোজা ক্রিয়া করে আমাদের
স্নায়ুতন্ত্রে। প্রেমের গল্পের ক্রিয়াও হরমোনের উপরে। ‘১০০টি প্রেমের গল্প’ নামক
বই তাই নামের জোরেই বেস্ট সেলার হয়ে যেতে পারে। কেন বাঙালি ‘বনলতা সেন’-কে ‘সাতটি
তারার তিমির’-এর চেয়ে আপন করে নিয়েছে, সেটাও হরমোন আর স্নায়ুর উত্তরে পাওয়া যেতে
পারে, কিছুটা হলেও, সেটা বাঙালির কবিতাভাবনা কবিতাচর্চা কবিতাযাপনের ব্যাপার
পুরোপুরি নয়।
এই ‘হরমোন’ এবং ‘প্রতিক্রিয়া’ কিন্তু ‘কাজ’
নয়। কাজ হল তাই, যা নিজের বেঁচে থাকাকে সার্থক করে তোলার জন্য করতে হয়, শুধু বেঁচে
থাকার জন্য নয়। ‘কাজ’-এর মধ্যে লেখা নামক পদার্থ আর লেখকের চিন্তা একাকার হওয়ার
জন্য অনেক কিছু পেরিয়ে বিস্তৃত হয়। ‘কাজ’
লেখকের বাঁচার প্রমাণ নয়, বাঁচার সম্মান। বেঁচে থাকতে হলে শ্বাস নিতে হয়, মলত্যাগ
করতে হয়। সেগুলো ‘কাজ’ নয়। যেমন প্রেমিকা
ল্যাং মারলে গলায় দড়ি দেওয়াকে আমরা কাজ বলতে পারি না, প্রেমিকা হাসলে কবিতা লিখতে
ঝাঁপিয়ে পড়াটাও কাজ নয়। কাজ হল তাই যা আপনি নির্বাচন করেন, সেটার পেছনে আপনার
সিদ্ধান্ত থাকে। অথবা। সেই কাজ আপনাকে বেছে নেয়, আপনি তাকে যুক্তিসহকারে গ্রহণ
করেন। ‘কাজ’-এর বাইরে আপনার কোনো পৃথিবী আছে কিনা, আপনি স্বয়ং আপনার ‘কাজ’-এর
দ্বারাই বিদ্যমান কিনা, সে নিয়ে ঢের তর্ক হতে পারে। অথবা, মেনে নেওয়া যেতে পারে, আপনার
কাজের ভিতর-বাহির আপনার মধ্যে এক হয়ে আছে, আপনার যে কোনো অক্ষর তাই বহুত্বের দিকে
যেতে পারছে, সহ্য করতে পারছে বহুত্বকে। ভারতীয় সমাজ অমন লেখককেই চায়, অমন রাজনীতিই
চায়। পায় না। প্রকৃত লেখক আর সমাজের প্রকৃত চাহিদার মধ্যে বিশেষ প্রতিষ্ঠানের
বিশেষ নীতি দাঁড়িয়ে থাকে।
।। অনুপম মুখোপাধ্যায় ।।